ঠোঁট কাটা ও তালু কাটা অপারেশন

শিশুর জন্ম এক বিস্ময়কর ঘটনা। কিন্তু যে শিশু জন্মগত ঠোঁটকাটা ও তালুকাটা নিয়ে জন্মায়, তার সেই জন্মানোটা পিতামাতার কাছে নির্মম আঘাতস্বরূপ হয়ে উঠে। বিশেষ করে যে পিতামাতা এমন ঘটনার কথা শোনেননি। কোন কোন পিতামাতা আবার এ বিকৃতিকে মেনে নিতেই পারেন না কারণ এ ধরনের বিকৃতি শিশুর মুখের গড়নটাই পুরোপুরি বদলে দেয়, কিছুতেই তাকে আর পাঁচটা স্বাভাবিক শিশুর সঙ্গে মেশানো যায় না। কেউ কেউ উদ্বেগে দিশেহারা হয়ে ভাবতে থাকেন- এ শিশুটিকে নিয়ে কি করবেন? কিন্তু এ ঘটনাকে দেখে যতটা ভয়ানক মনে হয়, আসলে ততটা নয়।

ঠোঁটকাটা ও তালুকাটা কাকে বলে ?

উপরের ঠোঁটের মূল গঠনের মধ্যে ফাঁকা বা ভাগ থাকলে তাকে বলে ঠোঁটকাটা। তালুকাটা শব্দটির ব্যবহার হয় যখন মুখের মধ্যেকার উপরের আস্তরনে ফাটল থাকে। এ ধরনের বিকৃতি মৃদু আকারে হতে পারে, তীব্র আকারেও হতে পারে। তীব্রতম আকারের ক্ষেত্রে ঠোঁটের ও তালুর বিভক্তির সাথে দাঁতের মাড়িতেও বিভক্তি থাকে। একে বলে ঠোঁট ও তালুর সম্পূর্ণ বিভক্তি। এ বিকৃতি একদিকে কিংবা দুই দিকেই থাকতে পারে।

বিকৃতি যে ধরনেরই হোক, সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে এর সুষ্ঠ সমাধান সম্ভব। এ চিকিৎসা এ বিষয়ে প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত প্লাস্টিক সার্জনকে দিয়েই করানো উচিত। প্লাস্টিক সার্জন চিকিৎসা করবেন; যদি প্রয়োজন হয় একজন দন্ত চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে, যাতে আপনার শিশুর দাঁতের সারি যথাযথ থাকে। যদি আপনার শিশুর শুধুমাত্র ঠোঁটের বিভক্ত (ঠোঁটকাটা) থাকে তাকে সারিয়ে দিতে একবার অস্ত্রোপচারই যথেষ্ট। শিশুর চেহারা ও কথা-বলা স্বাভাবিক হয়ে যাবে এবং কয়েক বছর পরে কাটা দাগটা প্রায় বোঝাই যাবে না। একই ভাবে, যখন শুধু তালুতে বিভক্তি (তালুকাটা) থাকে, সেক্ষেত্রে একবার অস্ত্রোপচারই মুখের মধ্যেকার উপরের আস্তরনের বিভক্তি বন্ধ করার জন্য যথেষ্ট। যদি আপনার শিশুর একই সঙ্গে বিভক্ত ঠোঁট ও তালু (ঠোঁটকাটা ও তালুকাটা) থাকে, তাহলে শৈশব বয়সে দুটি বা তিনটি অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হবে।

কত শিশুর এরকম হয়?

বাংলাদেশে আনুমানিক প্রতি ৫০০ জন শিশুর মধ্যে একজন জন্মায় এ বিভক্তির বিকৃতি নিয়ে। বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৫০০০ শিশু এ বিভক্তিজনিত সমস্যা নিয়ে জন্মায়।

বাচ্চাকে কিভাবে খাওয়াবেন?

মায়ের দুধের কোন বিকল্প নেই। তাই শুরু থেকেই মায়ের দুধ খাওয়ানোর চেষ্টা করতে হবে। আংশিক ঠোঁট বিভক্তি থাকলে মায়ের বুকের দুধ টেনে খেতে কোন সমস্যা হয় না। তবে সম্পূর্ণ ঠোঁট বিভক্তির জন্য বুকের দুধ টেনে খেতে কিছুটা সমস্যা হতে পারে। তালু বিভক্তি থাকলে বুকের দুধ টেনে খাওয়া সম্ভব না। তবে মায়েরা শিশুর মুখের টানের সাথে তাল মিলিয়ে স্তনকে সঙ্কুচিত করে শিশুকে বুকের দুধ টেনে খেতে সহায়তা করতে পারেন। যদি শিশু বুকের দুধ টেনে খেতে না পারে, তাহলে পাম্পের সাহায্যে বুকের দুধ বের করে চামচে করে খাওয়াতে পারেন। যদি কোন অবস্থাতেই বুকের দুধ খাওয়ানো সম্ভব না হয়, তাহলে শিশু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী শিশু খাদ্য হিসেবে অন্য দুধ খাওয়াতে হবে। দুধ খাওয়ানোর জন্য বাটি চামচ ব্যবহার করা সবচেয়ে ভাল। শিশুকে বসানো ভঙ্গিতে মাথা উপরের দিকে রেখে চামচ থেকে দুধ ঢালতে হবে জিভের পেছন দিকে। খাওয়ানোর কাজটা খুব ধীরে করতে হবে।

ঠোঁট ও তালু বিভক্তি শিশুর চিকিৎসাঃ

জন্মের পরপরই আপনার শিশুকে একজন প্লাস্টিক সার্জন দ্বারা পরীক্ষা করানো উচিত। এর ফলে বিভক্তির গুরুত্ব বা মাত্রা কতখানি তা নির্ধারণ করা সম্ভব হবে এবং আপনিও শিশুর ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করার সুযোগ পাবেন। এরপর প্রয়োজন হবে শিশুর পূর্ণ তত্তবাবধানের জন্য একাধিক বিশেষজ্ঞের একটি টিম। এই টিমের প্লাস্টিক সার্জন ঠোঁট ও তালু বিভক্তির অস্ত্রোপচার করবেন। দাঁত ও মাড়ির সমস্যা সমাধানের জন্য রয়েছেন অরথোডন্টিস্ট। বাকশক্তি বিকাশের জন্য রয়েছেন স্পীচ থেরাপিস্ট। এছাড়া শিশু বিশেষজ্ঞ ও নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেয়ার প্রয়োজন হতে পারে।

ঠোঁট কাটা রোগীর অস্ত্রোপচারঃ

জন্মগত ঠোঁট কাটা রোগীদের তিন থেকে ছয় মাস বয়সে অস্ত্রোপচার করাতে হয়। শিশুর শরীরের ওজন বয়স অনুযায়ী ভাল অবস্থায় হওয়া চাই। এ বয়সের বড় যে কোন রোগীর অস্ত্রোপচার করা হয়।

তালু কাটা রোগীর অস্ত্রোপচারঃ

শিশু কথা বলা শুরু করার আগেই তালু কাটা রোগীর অস্ত্রোপচার করাতে হয়। শিশুর যদি অন্য কোন সমস্যা না থাকে তাহলে ৯ মাস থেকে ১৮ মাস বয়সে তালু কাটা অপারেশন করানো উচিত। যত দেরীতে অপারেশন করা হবে, শিশুর স্বাভাবিক কথা বলার সম্ভবনা ততই কমতে থাকবে। মনে রাখতে হবে সঠিক সময়ে সঠিকভাবে অপারেশন করার উপর নির্ভর করছে শিশুর স্পষ্ট কথা বলা।

মাড়ি কাটার জন্য অস্ত্রোপচারঃ

সাধারণত বাচ্চার বয়স সাত থেকে নয় বছর হলে, মাড়ির অপারেশন করাতে হয়।

নাকের বিকৃতির অস্ত্রোপচারঃ

ঠোঁট কাটার সাথে অনেক সময় নাকের বিকৃতি থাকে। নাকের বিকৃতির জন্য অস্ত্রোপচার ষোল থেকে আঠারো বছর বয়স্যা করাতে হয়।

শিশুর দাঁতের ধারাবাহিক যত্নঃ

ঠোঁট/তালু কাটা নিয়ে যে শিশুর জন্ম হয় তার ক্ষেত্রে দাঁতের যত্ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ ধরনের বেশিরভাগ শিশুদের একটি বা দুটি দাঁতের অস্বাভাবিকতা থাকে, হয় উঠেনি বা অস্বাভাবিক স্থানে রয়েছে। এজন্যেই প্রত্যেক ঠোঁটকাটা/ তালুকাটা শিশুকে নিয়মিত দাঁতবিষয়ক বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে রাখা উচিত। যদিও দাঁতের কার্যকরী চিকিৎসা তিন থেকে সাড়ে তিন বছর বয়সের আগে শুরু হয় না, তবুও সর্বাঙ্গীন চিকিৎসা পরিকল্পনার জন্য শৈশবেই মূল্যায়ন করা জরুরী। অরথোডন্টিষ্ট দাঁতের সমস্যার যন্ত্রপাতি, বন্ধনী, প্লেট ইত্যাদির সাহায্যে ব্যবস্থা নেন। এসবের জন্য শক্ত ও সুস্থ দাঁত প্রয়োজন। দাঁতের পরিচ্ছন্নতার উপর গুরুত্ব দিন। যখন আপনার শিশু প্রয়োজনীয় বয়সে পৌঁছে যাবে তাকে ভালো করে দাঁত ব্রাশ করার কায়দা শিখিয়ে দিন।

  • Call us: 01556304153
  • Click to Chat
    Scroll to Top